সৌমিন খেলন : গ্রামের সনাতনধর্মের কোনো বাসিন্দার মৃত্যু হলে সৎকার কাজ নিয়ে ঘটতো নানারকম বিপত্তি। সৎকারের যথাযথ স্থান না থাকায় দুর্ভোগ বা দুর্ভাগ্যের কোনো ইয়ত্তা ছিলো না বলেই ভুক্তভোগীদের দাবি।
তবে বহুবছর পর নানা আন্দোলন সংগ্রামের পর এবার এসব দুর্ভোগের অবসান ঘটলো। দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা জমিতে স্থায়ীভাবে গড়া হলো শতবছরের পুরাতন এই মহাশ্মশান ও মন্দির।
গ্রামবাসীর যুক্তিযুক্ত এমন দাবি বা চাহিদার প্রয়োজন মিটাতে ঢাকায় বসেও যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন এলাকার সন্তান দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র সাংবাদিক রাজন ভট্টাচার্য।
যখন যেখানে যেভাবে চেষ্টা বা কথা বলা দরকার তিনি তাই করেছেন নিজের ব্যক্তিগত কাজের ব্যঘাত ঘটিয়েও। তার একান্ত চেষ্ঠায় গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে সংগ্রামে হয়েছেন জয়ী আর তারই সাথে স্থায়ীভাবে তারা গড়তে পেরেছেন মহাশ্মশান।
বলা হচ্ছে, নেত্রকোনা সদর উপজেলার সিংহের বাংলা ইউনিয়নের বাংলা গ্রামের মহাশ্মশানের কথা। শ্মশান দখল নিয়ে এরআগে দেশের প্রথম সারির একাধিক গণমাধ্যমে একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
অবশেষে পূরণ হয় গ্রামবাসীর দাবি। ফিরে পায় তারা শেষ বিদায়ের ঠিকানা বা শেষ স্টেশন মহাশ্মশানটি। বাংলা এলাকার নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ সড়কের রেল সড়কের লেভেল ক্রসিংয়ে শ্মশানটির অবস্থান।
শনিবার (১৪ নভেম্বর) বিকেলে এক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে মহাশ্মশান ও মন্দির উদ্বোধন করা হয়।কৃষি মন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিয়ে প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধন করেন।
শ্মশান কমিটির সভাপতি কেশব সেনের সভাপতিত্বে ও জনকণ্ঠের সিনিয়র সাংবাদিক রাজন ভট্টাচার্য’র পরিচালানায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছাড়াও ভিডিওতে সংযুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী খান খসরু, সংরক্ষিত নারী আসনের স্থানীয় সংসদসদস্য হাবিবা রহমান খান শেফালী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জুয়েল, জেলা কৃষক লীগের সভাপতি কেশব সরকার প্রমুখ।
রাজন ভট্টাচার্য বক্তব্য দিতে গিয়ে জানান, শ্মশানটি উদ্ধার করতে গিয়ে নানারকম জটিল ও তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন তিনি। তারপরও হাল ছাড়েননি বরং গ্রামবাসীর সাথে থেকে লড়াইটি চালিয়ে গেছেন। অবশেষে সফলতা এসেছে উদ্ধার হয়েছে দখল করা জমি এবং গড়ে তোলা হয়েছে মহাশ্মশান ও মন্দির।
রাজন ভট্টাচার্য আরো জানান, যখন দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধারে নানারকম চেষ্টা হচ্ছিলো তখন অনেক ঝড়ঝাপটার সম্মুখীন হয়েছেন। তৎকালীন নেত্রকোনার পুলিশ সুপার (এসপি) মোবাইল ফোনে জানিয়েছিলেন সাংবাদিকের (রাজন) নামে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছে।
তখন প্রতিত্তোরে পুলিশ সুপারকে তিনি বলেছিলেন, মামলা হয়েছে আপনি আইনগত ব্যবস্থা নেন। শ্মশান উদ্ধার করতে গিয়ে যদি জেল খাটতে হয় মিথ্যা অভিযোগের সাজানো মামলায় তবে আমি একবার নয় সত্তরবার জেল খাটবো। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম প্রয়োজনে দেশের যতো এমপি মন্ত্রী আছেন তাদের প্রত্যেকের দ্বারেদ্বারে যাবো।
বিশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে কারো কাছে কিছু চাইনি তবে শ্মশানটি উদ্ধারের দাবি নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াবো। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে হলে তাই করবো প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।
উল্লেখ্য, স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্মশান কমিটি সূত্রে জানা যায়, বাংলা গ্রামের সনাতনধর্মের মানুষ ১৯১২ সাল থেকে ব্যক্তি মালিকা ৩৫ শতক জায়গা শ্মশানঘাট হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। পরে ১৯৪৮ সালে ওই এলাকা দিয়ে রেল সড়ক চালু হলে জায়গাটি রেল মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে গেলে শ্মশানের জন্য তা আবার রেল বিভাগ থেকে ইজারা নেওয় হয়।
কিন্তু গত জোট সরকারের আমলে শাহাজাহান মিয়া নামে রেলের অস্থায়ী এক কর্মচারী ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ওই জায়গাটির একাংশ ইজারা নেন বলে দাবি করেন। পরে কিছু অংশ সিংহেরবাংলা এলাকার আব্দুল কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রিও করে দেন তিনি। এর পর তারা ওই জায়গাটি দখল করে করাতকল, বেকারিসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তারা।
এ নিয়ে শ্মাশান কমিটির লোকজন ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রেল মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হলে রেল বিভাগ ওই সম্পত্তিটি হিন্দু সম্প্রদায়ের মহাশ্মাশান হিসেবে ব্যবহারের লিখিত অনুমতি দেয়। পাশাপাশি রেল কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে ওই সম্পত্তির ওপর নির্মিত দখলদারদের স্থাপনাগুলোও উচ্ছেদ করে দেন। কিন্তু আব্দুল কুদ্দুস, তার ভাই মঞ্জিল মিয়াসহ দখলদাররা এতেও ক্ষান্ত হননি।
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন শ্মাশানের জায়গা উদ্ধারে ইট দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেন। সিংহের বাংলা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি দেওয়ান মঞ্জু, ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য তাহের মিয়াসহ বেশ কয়েকজন বলেন,
‘আমরা এলাকার সচেতন মানুষ সবাই মিলে শ্মশানের জায়গাটি দীর্ঘদিন পর হলেও দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি। শত বছরের পুরোনো এই শ্মাশানটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মারা গেলে তাদের সৎকার করা হয়। কিছু দুষ্কৃতকারী তা দখলে নিয়েছিল।’