সৌমিন খেলন : পার পেয়ে যাওয়া হত্যাকারীদের দীর্ঘ বিশ বছরের মাথায় আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন বিচক্ষণ আর চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন (পিপিএম)। তিনি গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল)।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার সিকির বাজারে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ, দিনগত গভীর রাতে ওষুধ ফার্মেসির ভিতরে পরিকল্পিত খুনের শিকার হন কর্মচারি প্রভাংশু বিশ্বাস। তিনি ছিলেন, কোটালীপাড়ার ভুতের বাড়ীর বাসিন্দা প্রেমানন্দ বিশ্বাস’র ছেলে।
ফার্মেসি মালিক প্রভাবশালী ব্যক্তি সুধীর কুমার গৌতম নিজের আত্মীয়স্বজন নিয়ে প্রভাংশুকে হত্যা করে বিষয়টি দুর্বৃত্তায়ন বা দোকান ডাকাতি বলে চালিয়ে দেন। হত্যাকান্ডের বিষয়টি পুরো জেলা জুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চে নিহতের ছোটভাই রমণী মোহন বিশ্বাস কোটালিপাড়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে দফায় দফায় এই উনিশ বছর ধরেই সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশসহ সিআইডি, পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা তদন্ত করেন। তবে নিহতের বাবার মতে প্রকৃত রহস্য উন্মোচনে হয়নি কোনো কূলকিনারা। একপর্যায়ে তিনি আদালতে নারাজি দেন।
পরে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত হন গোপালগঞ্জের সদর সার্কেল অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন। তিনি নিজের কর্মদক্ষতা বিচক্ষণতায় মূল ঘটনায় পৌঁছে দীর্ঘ বিশ বছরের মাথায় এসে প্রকৃত হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে করেছেন গ্রেফতার। এরই সাথে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
সেই রাতের হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছানোয়ার হোসেন এনএনবি বাংলাকে জানান, প্রভাংশু বিনা পারিশ্রমিকে, জাস্ট একটি ড্রাগ লাইসেন্সের আশায় চারবছর ধরে সুধীর কুমার গৌতম’র ওষুধের দোকানে চব্বিশ ঘন্টার কর্মচারী হিসেবে শ্রম দিচ্ছিলেন।
গৌতম কথা দিয়েছিলেন যে পরিমাণ খরচ লাগুক তিনি প্রভাংশুকে একটি ড্রাগ লাইসেন্স করিয়ে দিবেন। যা দিয়ে পরে প্রভাংশু নিজেই একটি ওষুধ দোকান খুলে বসতে পারবেন। এদিকে দীর্ঘদিনের বিনা পারিশ্রমিকের কর্মচারী ও মালিকের গভীর সম্পর্কের সূত্র ধরে খাওয়াদাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে গৌতমের বাড়িঘরে আনাগোনা করতেন প্রভাংশু।
এই আনাগোনায় গৌতমের স্ত্রী ও বোনের সাথে প্রভাংশু অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। একসময় বিষয়টি টের পেয়ে যান গৌতম ; তবে চুপ থেকে নীরবেই হত্যাকান্ডের ছক আঁকতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রভাংশুকে খুন করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করেন গৌতমসহ হত্যাকারী তার স্বজনরা।
তারা অর্থাৎ হত্যাকারী গৌতম, সুশীল দাস ও দেবাশীষ বিশারদ ২০০১ সালের ১৫ মার্চ, দিনগত গভীর রাতে ফার্মেসিতে গিয়ে ঘুমন্ত প্রভাংশুকে ডেকে তুলেন। ফার্মেসির ভিতরে ঢুকে তারা তাকে গলায় বৈদ্যুতিক ক্যাবল ও রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরে ঘটনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে দোকানের সমস্ত ওষুধপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখে বাসায় চলে যান।
অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়েরের পর বিভিন্নভাবে আড়াল এই আসামিরা মামলার বাদিকে প্রভাবিত করেন। লক্ষ্য ছিলো মামলাটি যেন সঠিক তদন্তে পৌঁছতে না পারে আর এ সুযোগে হত্যার দায় থেকে রক্ষা পেয়ে যান তারা। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। দীর্ঘ বিশ বছরের মাথায় বেরিয়ে আসলো প্রকৃত সত্য।
পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান- গ্রেফতার হত্যাকারীরা হলো, ফার্মেসি মালিক গৌতম ও তার বেয়াই দেবাশীষ বিশারদ। এই দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং হত্যাকান্ডের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তাপস রায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এদিকে প্রভাংশুর বাবা প্রেমানন্দ বিশ্বাস, ভাই হিরন্ময় বিশ্বাস, প্রতিবেশি ডা. পুলিন বিশ্বাস ও লিয়াকত আলীসহ এলাকাবাসীর দাবি অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি। এরই সাথে তারা পুলিশ কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন’র সততা নিষ্ঠা নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারা বলেন- ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রতি জেলায় এমন পুলিশ কর্মকর্তা একজন করে থাকলেও সাধারণ মানুষের কেবল মঙ্গলই হতো।