সৌমিন খেলন : সরকারি কাজে বাধা ও একপর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হামলা চালিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জনকে আহত করেছে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার সোশ্বেরী নদীতে অবধৈভাবে বালু উত্তোলনকারী শ্রমিকরা। পরে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (দুর্গাপুর সার্কেল) মাহমুদা শারমীন নেলী’র নেতৃত্বে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শাহ নূর এ আলমসহ থানা পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। আহতদের উদ্ধার করে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করানো হয়।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নারায়ণ চন্দ্র বর্মণ এদিকে পরিচালিত করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় আদালতের নির্দেশে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত পঞ্চাশটি অবৈধ ড্রেজার মেশিন। তারই সাথে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা অবধি বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার জন্য দেয়া হয় নির্দেশ।
এনএনবি বাংলাকে তিনি জানান, দুপুরে ঘাটে গেলে প্রথমে বালু উত্তোলন বন্ধ করে কথা বলতে বলা হয়। এতেই চরমভাবে তারা ক্ষেপে যান এমনকি কিছু বুঝার আগেই বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়ে মারতে থাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত টিমের সদস্যদের লক্ষ্য করে। এসময় পুলিশ কর্মকর্তাসহ আহত হন ছয়জন।
বুধবার (০৯ ডিসেম্বর) দুপুরে নদীর ১ নম্বর বালু ঘাটে হামলার শিকার হয় ভ্রাম্যমাণ আদালত টিমের সদস্যরা। দুর্গাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শাহ নূর এ আলম এনএনবি বাংলাকে জানিয়েছেন, ওই ঘাটটির ইজারাদার সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাক আহমেদ রুহী।
তিনি জানান, হামলায় উপ-পরিদর্ক (এসআই) মো. রুকন উদ্দিন, পুলিশ সদস্য খলিলুর রহমান, রুবেল মিয়া, দুর্গাপুর ভূমি অফিস কর্মচারী নজরুল ইসলাম, এরশাদুল ইসলামসহ ঘাটের শ্রমিক রফিক ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ঘন্টারও বেশি সময় লেগে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে আহতদেরকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়।
এক নম্বর বালু মহাল ব্যতিত অন্যান্য ইজারাদাররা জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতেই শুধু হামলা নয়, এই এক নম্বর ঘাট থেকে বালু মহালের সীমানা নিয়েও চলতি বছরের ১৩ জুন থেকে সৃষ্টি করেছিলো জটিলতা। পরে এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের থেকে জেলা প্রশাসন বরাবর করা হয়েছিলো অভিযোগ। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিলো সংবাদ। যদিও সংবাদ মাধ্যম থেকেই জানা যায়, এ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছেন অভিযুক্তরা। উল্টো তারাও জানিয়েছিলেন তাদরে নিজেদের পক্ষ থেকেও অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দেয়ার পক্রিয়া চলছে।
এতো গেলো বালু মহাল বা ইজারাদারদের কথা। এবার আসা যাক যেখান থেকে করা হয় বালু উত্তোলন সেই উপজেলা বা এলাকার মানুষরা কেমন আছেন? চব্বিশ ঘন্টার ড্রেজার চালানোর শব্দ আর ছুটে চলা ছোট বড় অসংখ্য পিকআপ ভ্যান, ট্রাক আর ট্রলি কেমন রেখেছে তাদের? এমন প্রশ্নে ছোট-বড় সকলেই কেবল দীর্ঘশ্বাসই ফেললেন শুধু। খানিক নীরবতার পর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, স্বোমেশ্বরীর বালু-পাথর বা কয়লা উত্তোলন আর পরিবহন কারো কারো জন্য সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হলেও গোটা উপজেলাবাসীর জন্য দুরারোগ্য এক ব্যধি।
বলতে গেলে কেউ-ই করছেন না নিয়মনীতির তোয়াক্কা। যে যার ইচ্ছেমতো চালাচ্ছেন এ ব্যবসা। এতে করে অতিষ্ঠ জনজীবন। ধ্বংসের মুখে পরিবেশ প্রকৃতি। আর বেপরোয়া যানগুলোর চালকের হাতে স্টিয়ারিং থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় মানুষ। সংশ্লিষ্টদের স্বার্থের কাছে মূল্যহীন মনুষ্যজীবন। গুটি কয়েক অপ্রতিরোধ্য বালু ব্যবসায়ীদের কাছে দীর্ঘদিন জিম্মি গোটা উপজেলাবাসী। নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা পরিচালনার দাবিতে মাঠে নামলে সেখোনেও ব্যবসায়ীসহ তাদের পোষ্য লোকেরা দাবি জানানো স্কুল ছাত্র-ছাত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের ওপর চালান হামলা!
এভাবেই চলছে আজ দুর্গাপুরবাসীর জীবন। এখানে পথচলা মানে জীবনের সাথে জুয়া খেলা। এমনই মনে করেন এখানকার মানুষ। কখন কোন ট্রাক বা ট্রাক্টর পিষে রেখে চলে যায় তার নিশ্চয়তা নেই। এরকম বহু উদাহরণ দিতে প্রস্তুত সাধারণ মানুষ। তাছাড়া শুকনো পথে হাঁটারও সুযোগ নেই। এখানে বারোমাসই যেন ঘোর বর্ষা। মানুষের দুঃখে কাঁদে যেন এখানকার পরিবেশ প্রকৃতি। ভিজা বালু পরিবহণের ফলে সারাক্ষণ পথঘাট পানি জমে হয়ে থাকে কর্দমাক্ত!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি জানান, সংবাদমাধ্যমে কথা বলে লাভ নেই। কাজ হবে না কোনো। কারণ, উল্লেখ করে তারা জানান, যারা দেখার তারা যদি কারণে বা অকারণে ঘুমান তবে কি হবে লিখে আর টিভিতে দেখিয়ে? কম তো আর হলো না! বাট কোনো পরিবর্তন আসেনি, মিনিমাম শৃঙ্খলায় আনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এদিকে নিয়মনীতি না মানা অবৈধ ড্রেজার ব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি বছরের পর বছর সোমেশ্বরী ভাঙ্গন কেবল ধারণ করছে তীব্র আকার। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে নদী ভাঙ্গন রোধ করতে প্রশাসনের কাছে বারবার করা হচ্ছে আবেদন।
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হামলার ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে যা রাতেই রেকর্ড করা হবে বলে এনএনবি বাংলাকে জানিয়েছেন দুর্গাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শাহ নূর এ আলম। তিনি জানান, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে অভিযানে নেমেছে পুলিশ। দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।